

উখিয়া থানার আঙিনায় চোখ রাখলেই দেখা মেলে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজি, টমটম, ভটভটি কিংবা পিকআপ ভ্যান। কোনোটি অর্ধেক মাটি চাপা, কোনোটি রোদে-বৃষ্টিতে জং ধরা লোহায় রূপান্তরিত। এগুলোর গায়ে ধুলোর স্তর আর মরিচার চিহ্নই বলে দিচ্ছে কত বছর ধরে এভাবে পড়ে আছে।
আইন অনুযায়ী বিভিন্ন সময় আটক করা এসব যানবাহন এখন ‘আলামত’। মালিক পক্ষের মামলা-মোকদ্দমা চলমান। আর এই দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁদে পড়ে থাকা অবস্থাতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যানগুলো। অথচ অনেকগুলোই ছিল শ্রমজীবী মানুষের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।
স্থানীয় এক ব্যক্তি হতাশা প্রকাশ করে বলেন,
“এই টমটমটা কিনতে আমার মামা কিস্তি করেছিল। চালিয়ে সংসার চলতো। এখন তিন বছর ধরে থানায় পড়ে আছে। এক্সেল-চাকা সব নষ্ট, ব্যাটারি গায়েব। এখন আর এটা চালানোর উপযোগীই না।”
এই মানুষগুলো আদালতের নীরব প্রক্রিয়ায় আটকে থেকে হারাচ্ছে তাদের জীবিকা। পেশাগত কারণে অনেকেই রিকশা, সিএনজি কিংবা ছোট ভ্যান কিনে সংসার চালাতেন। কিন্তু গাড়ি জব্দ হওয়ার পর একদিকে মামলা, অন্যদিকে গাড়ির অচলাবস্থা—দু’দিক দিয়েই ধসে পড়েছে জীবনের ভিত্তি।
থানা সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া থানায় বর্তমানে ৫০টিরও বেশি যানবাহন বিভিন্ন মামলার আলামত হিসেবে পড়ে আছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমূল্যের মোটরসাইকেল, একাধিক সিএনজি, পিকআপ ভ্যান ও প্রাইভেট কার। অনেক সময় চুরি, দুর্ঘটনা, অবৈধ মালামাল বহন বা অন্য কোনো অভিযোগে এসব যানবাহন আটক হয়। এরপর আদালতের নির্দেশ ছাড়া এগুলো ফেরত দেওয়া সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে ইনচার্জ এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,
“আমরাও চাই না এই গাড়িগুলো নষ্ট হোক। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে এগুলো আদালতের আদেশ ছাড়া না সরানো যায়, না ফেরত দেওয়া যায়। অনেক সময় মামলার নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থানায় জব্দ হওয়া যানবাহন সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত গ্যারেজ বা কভারড শেডের ব্যবস্থা নেই। খোলা জায়গায় পড়ে থেকে দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায় যন্ত্রাংশ। অনেক সময় এসব গাড়ি থেকে যন্ত্রাংশ খোয়া যাওয়ার অভিযোগও ওঠে, যা তদন্তকে জটিল করে তোলে।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দূর রহিম বলেন,
“যানবাহনগুলো মালিকপক্ষের স্বত্ব থাকলেও মামলার কারণে আদালতের অনুমতি ছাড়া কিছুই করা যায় না। তবে মামলা চলাকালে ব্যবহারের জন্য মালিককে কিছু শর্ত সাপেক্ষে আদালত থেকে গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিকরা আইনি প্রক্রিয়া জানেন না, কিংবা ব্যয়বহুল হওয়ায় এগিয়ে আসেন না।”
এই পরিস্থিতি নিরসনে দ্রুত বিচার ও আইনি প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি উঠেছে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে। বিশেষ করে ছোট ও দরিদ্র মালিকদের জন্য পৃথক কোনো সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
উপজেলার একজন সচেতন নাগরিক বলেন,
“একটা টমটম বা সিএনজি গরীব পরিবারের জন্য শুধু যানবাহন না, সেটাই তাদের ঘরের চাল, ছেলের স্কুল ফি, মেয়ের বিয়ের সম্বল। সেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া এক ধরনের সামাজিক হত্যাকাণ্ড।”
সরকারি নীতিনির্ধারক মহলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, কেবল আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে থেকে যেন আর কোনো পরিবার তার জীবনের স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলে।
পাঠকের মতামত